এ যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার দশা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কুক্ষিগত করেন তিনি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে একের পর এক লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে তার সময়ে। একে একে প্রায় ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লুটের এ প্রতিযোগিতায় একদিকে গুটিকয়েক ব্যক্তি আঙুল ফুলে কলাগাছ, অন্যদিকে হাজার হাজার আমানতকারীর পথে বসার উপক্রম হয়েছে। যিনি এ অভিযোগের কেন্দ্রে, তিনি হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএস) পরিচালকদের এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) জানিয়ে ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান আমানতকারীরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের মূল হোতারা পালিয়ে গেছেন দেশের বাইরে। শাহ আলম পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক।
আমানতকারীদের দেয়া সেসব চিঠির বেশ কয়েকটি কপি জাগো নিউজের হাতে এসেছে। একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৮ সালের শুরু থেকে নিয়মিতভাবে চেক ডিজঅনার, মুনাফা প্রদানে বিলম্ব এবং আমানত নগদায়নের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হতে থাকে পিপলস লিজিং। ফলে অফিসে পাওনা টাকার জন্য দলে দলে ভিড় করতে থাকেন গ্রাহকরা। এ নিয়ে ঝগড়াঝাটি ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। ২০১৩ সালে পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম হোসেন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইতোপূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু অনিয়মিত ঋণ প্রদানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। এতে কোম্পানি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তখন পিপলস লিজিংয়ের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।’
‘পরে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় পরিচালনা পর্ষদে ন্যক্কারজনক পরিবর্তন ঘটে। নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে সমাজে অপরিচিত, দুর্নীতিবাজ এবং বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির লোকদের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। এরপর কোম্পানি থেকে অভিজ্ঞ যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি ও মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করেই অন্যায়ভাবে ক্রমাগত ছাঁটাই শুরু হয়। পাশাপাশি যোগ্যতা, গুণাগুণ, সততা ও অভিজ্ঞতার বিচার না করে উচ্চপদস্থ পদে পর্ষদের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দেয়া হতে থাকে, যারা নতুন পরিচালকদের অন্যান্য কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বিধান থাকলেও পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদে চার-পাঁচ বছর থেকে ছয়জন স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন, যা সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থী।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার, পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিপলস লিজিংয়ের সাবেক এমডি ড. ইউসুফ খান, সাবেক এমডি সামি হুদা, স্বতন্ত্র পরিচালক শেখর কুমার হালদার, সুকুমার মৃধা, অমিতাভ অধিকারী ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট কাজী আহমেদ জামাল—সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ ও দুর্নীতির মূল কাজগুলো করেন। একই ব্যক্তি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) প্রভৃতিতে পরিচালক হিসেবে বহাল আছেন, যা পুরোটাই বেআইনি।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রলোভনমূলক এফডিআর স্কিমের মাধ্যমে বহু টাকা সংগ্রহ করলেও এটা ফেরত দিতে না পারা, কোম্পানির বিভিন্ন স্থাবর সম্পদ বিক্রি করা, অন্য গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলেও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ২৮০ কোটি টাকা ফেরত এবং কমিশন বাণিজ্যের মতো কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেয়ার জন্য তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কতিপয় উচ্চপদস্থ অসাধু কর্মকর্তা, বিশেষত মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমের সহযোগিতা পেতেন। পাশাপাশি যোগসাজশে স্বল্পসময়ে গোপনীয় বাজার থেকে পিএলএফএসকে অবসায়িত করে বিশাল দুর্নীতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন তারা।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পিপলস লিজিংয়ের পর্ষদ ভেঙে দিলে ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং নির্বাহী পরিচালক বরাবর চিঠি পাঠান তৎকালীন চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম। চিঠিতে জানানো হয়, পিপলস লিজিংয়ের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে তিনজন প্রতিষ্ঠানের নতুন পরিচালক হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছে আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উজ্জ্বল কুমার নন্দী, ওরিক্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নং চাও মং এবং ড্রাইনুন অ্যাপারেলস লিমিটেডের কাজী মোমরেজ।
কিন্তু পরিচালক হওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল, তা সঠিকভাবে দাখিল করতে পারেননি তারা। এছাড়া পরিচালক হতে প্রয়োজনীয় শর্তাদি পূরণে ব্যর্থ হন তিনজনই।
আবেদনকারী তিনজনের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তারপরও একই বছরের ১২ অক্টোবর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের নতুন পরিচালক নিয়োগ প্রসঙ্গে একটি চিঠি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ড্রাইনুন অ্যাপারেলস লিমিটেডের প্রস্তাবিত প্রতিনিধিদের পর্ষদে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে অনাপত্তি জ্ঞাপন করা যাচ্ছে। যদিও আগেই তাদের অযোগ্য ঘোষণা করে পিপলস লিজিং।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হলো শাহ আলমকে
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নীতি প্রণয়ন ও দেখভালের দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ। ২০১৩ সাল থেকে ওই বিভাগটির মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন শাহ আলম। এরপর ২০১৭ সালে নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি পাওয়ার পরও তিনি বিভাগটি তদারকির দায়িত্বে ছিলেন।
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য চাপা দেয়ার অভিযোগ ওঠায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফিশিয়াল আদেশে ওই বিভাগটি তদারকির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে। ৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হকের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে স্টাফ ‘ল’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’ এরপর তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের অপরাধীদের শুধু চাকরিচ্যুত করলেই হবে না। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সম্পদ ও অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অপরাধের চিত্র অনেক দিনের, চিঠিও অনেক দিন ধরে পাঠানো হচ্ছে। আমানতকারীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবগত থাকা উচিত। কোনো একটি ডিপার্টমেন্টের একজন না জানলেও অন্য কর্মকর্তাদের তো জানার কথা।
তিনি বলেন, অপরাধী যেই হোক তাকে ছাড় দিলে বা চাকরিচ্যুত করলে সমাধান আসে না। আমি ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলাম, আর আমাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো, এতে লাভ কী? আমি তো এ টাকা দিয়ে ভালোমতো চলতে পারবো। এজন্য প্রশাসনিক যেটা প্রতিষ্ঠান করবে, অন্যদিকে আইনের মাধ্যমেও বিচার করতে হবে। অবশ্যই তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আমানতকারীদের ফিরিয়ে দিতে হবে।